ডিএসএফ নিউজ বাংলা ডেস্ক রিপোর্টঃ ছিলেন হকিং ও ফাইনম্যানের ভালো বন্ধু, ক্যামব্রিজ – ক্যালটেকের মতো বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ উপেক্ষা করে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন ড. জামাল নজরুল ইসলাম!
তিনি ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন কলকাতায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামে আসেন এবং চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন নবম শ্রেণি পর্যন্ত। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের মারির লরেন্স কলেজ থেকে সিনিয়র ক্যামব্রিজ (বর্তমানে ও লেভেল নামে পরিচিত) এবং হায়ার সিনিয়র ক্যামব্রিজ (এ লেভেল) পরীক্ষা পাস করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ট্রাইপজে তিন বছরের কোর্স দুই বছরে শেষ করেন। পরের বছর এখান থেকেই সম্পন্ন করেন মাস্টার্স। ১৯৬৪ সালে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে ফলিত গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করে যোগ দেন সেখানকার ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন।
১৯৭১ – ১৯৭২ এই দুই বছর তিনি ক্যালটেক অর্থাৎ, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি – তে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। এরপর ১৯৭৩-৭৪ সালে লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের শিক্ষক, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মনে সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দুর্লভ ও সম্মানজনক ডক্টর অব সায়েন্স বা ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে।
ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন। ১৯৮৭ সালে তিনি চবিতে গড়ে তোলেন রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকেল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (RCMPS)। এই গবেষণাকেন্দ্রের উদ্বোধনী সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালাম। ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। ২০০৬ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করা শেষে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পরও ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এছাড়া, তিনি আমৃত্যু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা বোর্ডের এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন।
ক্যামব্রিজে অধ্যয়নকালীন সময়ে তাঁর বন্ধুত্ব হয় আরেক জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর সাথে। প্রফেসর রিচার্ড ফাইনম্যানও জামাল নজরুল ইসলামের সহকর্মী ও বন্ধু ছিলেন। ক্যালটেক ইউনিভার্সিটিতে তাঁরা একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন এবং থাকতেনও কাছাকাছি বাসায়। এছাড়া ফ্রিম্যান ডাইসন, সুব্রহ্মনিয়াম চন্দ্রশেখর, পাকিস্তানের আবদুস সালাম, ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অমিয় বাগচী, জয়ন্ত নারলিকার, ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জিম মার্লিস প্রমুখের সাথেও ছিল তাঁর সুসম্পর্ক।
ড. জামাল নজরুল ইসলামের গবেষণার প্রধান ক্ষেত্রগুলো ছিল ফলিত গণিত, তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান, গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞান, মহাকর্ষ তত্ত্ব, সাধারণ আপেক্ষিকতা, গাণিতিক কসমোলজি, ফ্লুইড ডাইনামিক্স এবং কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি। তাঁর অনেক গবেষণা নিবন্ধ বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নালসমূহে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৭ সালে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির কোয়ার্টারলি জার্নালে ‘পসিবল আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’ শীর্ষক একটি টেকনিক্যাল পেপার প্রকাশ করেন জামাল নজরুল ইসলাম।
নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ, ফ্রিম্যান ডাইসন, স্টিফেন হকিং এবং জয়ন্ত নারলিকারের অনুরোধে তিনি ১৯৮৩ সালে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ রচনা করেন যা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এই বইটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। পরের বছরই কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি বই ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’। ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামক তিনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেছেন। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় এই বইটি। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের অধীনে ঘূর্ণায়মান সিস্টেমের গাণিতিক এবং ভৌত বৈশিষ্ট্য এই বইটির মূল বিষয়বস্তু। নক্ষত্র, গ্রহ বা ব্ল্যাক হোলের মতো ঘূর্ণায়মান ভরের উপস্থিতিতে মধ্যাকর্ষণ বল কীভাবে আচরণ করে তা বোঝার জন্য এই গবেষণা অপরিহার্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালীন তিনি রচনা করেন ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি’। ১৯৯২ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় বইটি! তিনি বাংলা ভাষায় রচনা করেন ‘কৃষ্ণ বিবর’ শীর্ষক একটি বই যা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে। ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ এবং ‘দ্য ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স’ও তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাকে মেডাল লেকচার পদক দেওয়া হয়। এছাড়াও পেয়েছেন পেয়েছেন বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস স্বর্ণপদক, রাষ্ট্রীয় একুশে পদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ এই কালজয়ী বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন। অনন্য সাধারণ গবেষণা এবং বাংলাদেশে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অবদানের জন্য ড. জামাল নজরুল ইসলাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

