বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সাম্প্রতিক অশান্তির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলোয় এসেছে—গত বছর রাশিয়া বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নিউক্লিয়ার জ্বালানি সরবরাহ করেছিল এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এই ঘটনা অনেকের কাছে এখন প্রশ্ন তুলেছে: যুক্তরাষ্ট্র কেন এই সহিংস অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছে? বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে জড়িত হতে পারে, যেখানে রাশিয়ার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করেছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় পারমাণবিক প্রকল্প, যা দেশের বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় একটি মাইলফলক। ২০১৫ সালে রাশিয়ার স্টেট অ্যাটমিক কর্পোরেশন রোস্যাটমের সঙ্গে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ৯০ শতাংশ রাশিয়ার ঋণে অর্থায়িত। প্রকল্পটি দুটি ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর নির্মাণের মাধ্যমে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, যা প্রায় ১৫ মিলিয়ন পরিবারের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাবে। গত অক্টোবরে, ২০২৪ সালের শুরুর দিকে, রাশিয়া প্রথম ব্যাচ নিউক্লিয়ার জ্বালানি ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছে, যা প্রকল্পটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নিউক্লিয়ার সুবিধা’ হিসেবে পরিণত করেছে।
এই ঘটনায় শেখ হাসিনা এবং পুতিনের ভিডিও কনফারেন্সিং ছিল একটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত। সোচিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং ঢাকায় হাসিনা ভিডিও লিংকের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে অংশ নেন, যেখানে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এর পরিচালক জেনারেল রাফায়েল গ্রোসি উপস্থিত ছিলেন। হাসিনা রাশিয়াকে ধন্যবাদ জানান, বলেন, “আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পরবর্তী পুনর্নির্মাণে রাশিয়ার সহায়তা আমরা কখনো ভুলব না।” পুতিনও আশ্বাস দেন যে রাশিয়া প্রকল্পটির পুরো জীবনচক্রে সহায়তা করবে, যার মধ্যে জ্বালানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত। এই চুক্তি বাংলাদেশকে বিশ্বের ৩৩তম নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদক দেশে পরিণত করেছে, যা দেশের শক্তি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এই রুশ-বাংলাদেশ যোগাযোগের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী? বিশ্লেষকরা বলছেন, হাসিনা সরকারের রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ২০২৪ সালের জানুয়ারি নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র হাসিনা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, যার মধ্যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং নির্বাচনী স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে সমালোচনা ছিল। হাসিনা মে মাসে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “একটি ‘সাদা দেশ’ (সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র) আমাকে নির্বাচনে অবাধ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে, বিনিময়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি চেয়েছে।” এই দ্বীপটি বঙ্গোপসাগরে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা চীন এবং রাশিয়ার স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত।
আগস্ট ২০২৪-এ শেখ হাসিনার পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত এবং ইতিবাচক। স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক মুখপাত্র বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।” সেনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা চাক শুমারও দ্রুত নির্বাচনের আহ্বান জানান। এই স্বাগত জানানোর পিছনে কি ছিল রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের নিউক্লিয়ার ডিল? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হাসিনার রাশিয়া-পন্থী নীতি যুক্তরাষ্ট্রের চোখে পড়ছিল চীনের প্রভাব বাড়ানোর একটি অংশ হিসেবে। রূপপুর প্রকল্পটি শুধু শক্তির জন্য নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতীক। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন জটিল হয়েছে, যা বাংলাদেশকে চীনের ইউয়ানে পেমেন্ট করতে বাধ্য করেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে মুহাম্মদ ইউনুসের অধীনে রূপপুর প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অ্যান্টি-করাপশন কমিশন দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে, যাতে শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ৫ বিলিয়ন ডলারের অভিযোগ রয়েছে। রাশিয়া সম্প্রতি ৬৩০ মিলিয়ন ডলারের সুদ পরিশোধের দাবি জানিয়েছে, যা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে জটিলতর হয়েছে। বিশ্লেষক আলী রিয়াজ বলেন, “এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের শক্তি স্বাধীনতার চাবিকাঠি, কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এটিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাগত জানানো এখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।”
বাংলাদেশের সংকট এখনো শেষ হয়নি। ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে যে অভ্যুত্থান হাসিনা সরকারকে উৎখাত করেছে, তা দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। রূপপুরের মতো প্রকল্পগুলো যদি রাজনৈতিক খেলার শিকার হয়, তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন স্বপ্ন আরও দূরের পথে চলে যাবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ—কোনো দেশের স্বার্থ যেন সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করে।